জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড-এর প্রথম জাতীয় সম্মেলন

Ecare Solutions

আজ ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, আমরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছি। এই উপলক্ষে নির্মূল কমিটির সহযোগী সংগঠন ‘জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড’-এর প্রথম জাতীয় সম্মেলনের অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আসাদুজ্জামান খান এমপি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জনাব কে এম খালিদ এমপি।

সকাল ১০টায় নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের শিল্পীবৃন্দের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের। এরপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভার প্রারম্ভে লালনগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গান পরিবেশন করবেন নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের শিল্পীবৃন্দ।

উদ্বোধনী অধিবেশনে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট-এর সাম্মানিক সভাপতি, নাট্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার; একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী; বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি চলচ্চিত্রনির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ; ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন; সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ এবং ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশন-এর সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নির্মূল কমিটির আইটি সেল-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।

সভাপতির ভাষণে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বহু বাধাবিঘ্ন, জেল-জুলুম-হত্যা মোকাবেলা করে গত তিন দশকে নির্মূল কমিটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের বৃহত্তম নাগরিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং বিস্তার লাভ করেছে পাঁচটি মহাদেশে।

‘৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আমরা নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াডকে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে চাই, যাতে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রসারে এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।’

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আসাদুজ্জামান খান এমপি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর আমরা দেখেছি রাজাকারদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। এরপর জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় এবং নির্মূল কমিটির সহযোগিতায় রাজাকারদের বিচার কাজ সম্পন্ন করেছি। নির্মূল কমিটির জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে যে লড়াই তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সংস্কৃতিচর্চা দেশকে কখনো পথ হারাতে দেয় না। আমি মনে করি উগ্রবাদ- জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নির্মূল কমিটির যে অগ্রযাত্রা সেই অগ্রযাত্রায় আমরা ভবিষ্যতে এই সংগঠনের পাশে থাকব।’

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব কে এম খালিদ এমপি বলেন, ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে আমরা যাত্রাপালা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। আমার একটি প্রস্তাব থাকবেÑ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চকে যাত্রামঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।’

নরওয়ের লোকসঙ্গীত গবেষক, লেখক ও আলোকচিত্রশিল্পী ওয়েরা সেথের বলেন, ‘এই বাঙালি সঙ্গীত ও সংস্কৃতি যদি না থাকতো, এই সাংস্কৃতিক চেতনা যদি মনের গভীরে না থাকতো- তবে এই বাংলাদেশ হতো না। এই দেশের ভাষা আমি জানতাম না। শুধু সুর জানতাম। আমি জানি এই সুর হৃদয় থেকে আসে। যেখান থেকে আপনাদের জন্ম হয়েছে সেই হৃদয়ের সুর আপনারা হারিয়ে ফেলবেন না।’

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট-এর সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমাদের বাঙালির আত্মাটা আছে লোকসংস্কৃতির মধ্যে- এটা আমরা ভুলে যাই। আমরা অবকাঠামোগতভাবে অনেক উন্নতি করেছি, কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। আমরা এই সরকারকে সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বলি, কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বরাদ্দ তলানীতে পড়ে আছে আজও। আমরা করি বাঙালি সংস্কৃতি সংরক্ষণে জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড কাজ করে যাবে।’

নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বিভিন্নক্ষেত্রে উন্নতি করেছি কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এখনো অন্ধকার বিরাজমান। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। এছাড়া আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি চলচ্চিত্রনির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ছিল যেখানে শাহরিয়ার কবিরের লেখা ‘রূপান্তরের গান’ ভারতের বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো যা মুক্তিযোদ্ধাদের দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭১ সালে নির্মূল কমিটির বর্তমান সভাপতি সেই সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের একজন সভ্য ছিলেন এবং আজও বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে নির্মূল কমিটির নেতৃত্বেই গঠিত হয়ে নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করা ‘জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড’-এরও নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন- যা খুবই আশাব্যাঞ্জক।

১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সংস্কৃতি মানুষকে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতির ভূমিকা অনেক। বর্তমান সময়ে সরকার ওয়াজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তেমন ব্যয় করে না। ধর্মের সাথে আমাদের বিরোধ নেই। সারাদেশে ৬৪টি জেলায় যেভাবে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে সেভাবে ৬৪টি জেলায় মডেল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেন নির্মাণ করা হয়- সরকারের কাছে আমাদের এই প্রস্তাব থাকবে।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ নানা দিক থেকে সমৃদ্ধি অর্জন করলেও মনোযোগতে উন্নতির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এর থেকে উত্তরণের জন্য নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক স্কোয়াড গঠিত হয়েছে যা অন্ধকারের মাঝে আলোর সঞ্চার করবে।’

তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিল যে কোন সময়ে নির্বিঘ্নে চললেও যাত্রাপালা চলতে পারে না এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিও পায় না।’

ফরিদা ফাউন্ডেশনের সভাপতি সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আশা করি, আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য সাংস্কৃতিক স্কোয়াড কাজ করে যাবে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ফিরে পেলে আমরা আমাদের শিকড়ের কাছে ফিরে যেতে পারব।’

Ecare Solutions
শর্টলিংকঃ