
আজ (১৯ মার্চ ২০২৩) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলায় আনেহলা ইউনিয়নে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিশুদের মেলার আয়োজন করেছে।
আয়োজিত এই ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল। নির্মূল কমিটির আনেহলা ইউনিয়নের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবীবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সভাপতি শহীদ সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, ঘাটাইল উপজেলার সভাপতি অধ্যাপক শামসুর রহমান মণি, পাকুটিয়া পাবলিক স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপিকা জীবুননিছা, সদ্য সাবেক কমান্ডার ঘাটাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেনসহ ঘাটাইল উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নির্মূল কমিটির আনেহলা ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশীদ।

বঙ্গবন্ধুর ১০৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৭ মার্চ ঘাটাইল উপজেলার ৫টি স্কুলের শিশুদের ভেতর ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ শীর্ষক রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নির্মূল কমিটির আনেহলা ইউনিয়ন। আজকের অনুষ্ঠানে নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ৭০জন শিশুকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম এবং দুই বিভাগে বিজয়ী ছয়জন ছাত্র-ছাত্রীকে বই উপহার দেয়। উপহার ও পুরস্কার প্রদানের পর উপস্থিত শিশুদের জলখাবার পরিবেশন করা হয়।
প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা এবং আগামী দিনের নাগরিকদের সম্মিলিত এই আনন্দ-উৎসবের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমরা কখনও স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রধান মিত্র ছিল প্রতিবেশী ভারত। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যও শহীদ হয়েছেন। আমরা যখন স্বাধীনতার কথা বলি, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন আমাদের শহীদদের আত্মদানের কথাও বলতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার শত্রুরা এখনও বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। বাংলাদেশকে তারা আবার পাকিস্তান বানাতে চাইছে। স্বাধীনতার শত্রু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করে আমাদের দেশ ও জাতিকে নিরাপদ করতে হবে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে নির্মূল কমিটির শীর্ষ নেতা কাজী মুকুল বলেন, ‘দেশের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার স্থাপন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গত ১৭ মার্চ আমরা ঢাকার নবাবগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধা মাধুরী বণিককে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করেছি যিনি তাঁর এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের গাছতলায় বসে শিক্ষাদানের পাশাপাশি গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার স্থাপন করেছেন। এ ধরনের উদ্যোগকে আমরা সব সময় উৎসাহিত করার পাশাপাশি সহযোগিতাও করব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ প্রচারের এই আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানি বাহিনী ঘাতক দালালদের সহায়তায় বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে’ মন্তব্য করে নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সভাপতি শহীদ সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘নির্মূল কমিটির বহুমুখী কার্যক্রম বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে যার মধ্যে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার কাজ সম্পন্ন করা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নষ্ট করতে চেয়েছিল। তাদের প্রথম আঘাত ছিল আমাদের মাতৃভাষার ওপরে।’
৭১ ও ৭৫-এর ঘাতকরা এ দেশে আজও সক্রিয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ মোটামুটি সম্পন্ন হলেও তাদের বংশধররা আজও বাংলাদেশে বিরাজমান। তারা বাংলাদেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল স্তরে অনুপ্রবেশ করেছে। ক্ষনে ক্ষনে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু এই কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তানরা এখনো বেঁচে আছি। এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কখনো হুমকির মুখে পড়তে দেব না। যে কোন মূল্যে ঘাতক ও ঘাতকদের বংশধরদের বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করবই।
সভাপতির বক্তব্যে নির্মূল কমিটির আনেহলা ইউনিয়নের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবীবুর রহমান বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব গাঁথা হারিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য বর্তমান পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিষয়গুলো তেমন একটা নেই। ঘাতক দালালদের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাম্প্রদায়িক চেতনা মুছে যাচ্ছে। যারা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। ঘাতকরা ব্লগার অভিজিৎকে হত্যা করেছে। অথচ ঘাতকরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে নির্মূল কমিটি যেভাবে কাজ করছে তা প্রশংসার দাবিদার। আমরা চাই এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকুক। আমরা সর্বদা নির্মূল কমিটির পাশে আছি এবং থাকবো।
সদ্য সাবেক কমান্ডার ঘাটাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, নির্মূল কমিটির সহায়তায় বর্তমান সরকার একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার করেছে। কিন্তু আমরা চাই, এদেশ থেকে তাদের পুরোপুরি নির্মূল করতে। আমাদের জীবদ্দশায় যেন ঘাতক দালাদের পুরোপুরি বিচার দেখে যেতে পারি এ প্রত্যাশায় নির্মূল কমিটির কাছে ব্যক্ত করছি।
ইব্রাহিম খাঁ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী তালুকদার বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে। সে যুদ্ধে ঘাতক দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। এই মীরজাফর বাহিনীর কারণেই পাকবাহিনী বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করে। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত করে। এদেশে যেমন মুক্তিযুদ্ধের সন্তানরা রয়েছে তেমনি সেই ঘাতকদের বংশধরেরাও রয়েছে। তাদেরকে নির্মূল করাই নির্মূল কমিটির মূল কাজ।
শহীদ সালাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ সরকার অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, নির্মূল কমিটির এধরনের কার্যক্রম সত্যি প্রশংসনীয়। ৩০ লক্ষ শহীদের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলতে হবে।
ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সহসভাপতি সমাজকর্মী শাহ আলম বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়নই নির্মূল কমিটির মূল লক্ষ্য। নির্মূল কমিটির সহায়তায় আজ যে অনুষ্ঠানমালা হয়েছে এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেভাবে পুরস্কৃত করা হচ্ছে তা সত্যি খুবই প্রশংসনীয়। আমরা চাই এ ধরনের কাজ অব্যাহত থাকুক। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যদি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তাহলে বাংলাদেশে অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে।
পাকুটিয়া পাবলিক স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপিকা জীবুননিছা বলেন, একাত্তরের ঘাতকরা বাংলাদেশে আজও সক্রিয়। সেই ঘাতকদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করেছিল। নির্মূল কমিটির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সক্ষম হয়েছেন। একাত্তরের ঘাতকদের সম্পূর্ণ বিচার করতে হলে নির্মূল কমিটির সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মকেও এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশকে ঘাতক দালাল মুক্ত করতে হবে।
অনুষ্ঠানের পর নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ মোঃ হাবিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার পরিদর্শন করেন এবং পাঠাগারের জন্য ১৬০টি বই উপহার প্রদান করেন।
